হাবল টেলিস্কোপ কি?মহাকাশবিজ্ঞানের একটি অসাধারণ আবিষ্কার

হাবল টেলিস্কোপ কি

Last Updated on: 31st অক্টোবর 2021, 03:03 অপরাহ্ন

চলুন বন্ধুরা আজ আমরা হাবল টেলিস্কোপ কি সেই সম্পর্কে জেনে আসি। মহাকাশ নিয়ে আমাদের আগ্রহ চিরন্তন। এই অসীম মহাশূন্যে যে কত অজানা রহস্য আছে তা আজও আমাদের কাছে পুরো পরিষ্কার নয়। তাই বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মহাকাশ সম্পর্কেও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে। এই হাবল টেলিস্কোপ তারই একটি অসাধারণ প্রয়াস।

হাবল টেলিস্কোপ কি?

হাবল টেলিস্কোপ হলো একটি মহাকাশে থাকা একটি বিশালকার টেলিস্কোপ। ১৯৯০ সালে ২৪এপ্রিল ডিসকভারি স্পেস শাটল এর দ্বারা এটি মহাকাশে প্রথম প্রবেশ করে।

তারপর থেকে এটি অবিরত কাজ করে চলেছে। এটির ওজন দুটি পূর্ণবয়স্ক হাতির ওজনের সমান আর দৈঘ্যে এটি একটি স্কুল বাস এর আকারের। এত ঘন্টায় প্রায় ৩০০ মাইল গতিতে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবীকে আর ভূপৃষ্ট থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৩৪০ মাইল।
একবার পৃথিবীকে পুরো প্রদক্ষিণ করতে হাবল এর লাগে মাত্র ৯৫ মিনিট।

এতো উপরে এতো শক্তিশালী হওয়াতে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে হাবল টেলিস্কোপ অনেক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বহু আলোকবর্ষ দূরে থাকা মহাকাশ এর নানা গ্যালাক্সি এর উপর গবেষণা তার ছবি ,সূর্য এর ম্যাগনেটিক বিকিরণ,নানা গ্রহ নক্ষত্র এর নানা রকম অধ্যয়ন ,নানা রকম রেডিও সিগন্যাল এর বিশ্লেষণ সব কিছুই করে এই হাবল টেলিস্কোপ। এককথায় অন্তরীক্ষের একটি চলমান গবেষণাগার বলা যেতে পারে হাবল টেলিস্কোপ।

হাবল টেলিস্কোপ নামটি এলো কি ভাবে ?

হাবল টেলিস্কোপ নামটি আসলে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল এর নাম এ দেয়া। ১৯৯০ এর দশকে তার মহাকাশ এর নানা গবেষণা যেমন মিল্কিওয়ে সহ আরো অন্য সব গ্যালাক্সি এর সম্পর্কে গবেষণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মহাকাশ এর বিং বাং তত্ত্বের সম্পর্কে তার রিসার্চ আজ বেশ কার্যকরী। আমাদের সৌরমণ্ডল যে একটি বিরাট বিস্ফোরণ এর ফলে সৃষ্টি আর তার পর থেকে আমাদের ইউনিভার্স যে ক্রমশ বেড়েই চলেছে এটি তারই গবেষণার ফলে জানা যায়।

তবে এতো কিছুর পরেও কিন্তু এই হাবল টেলিস্কোপে এর শুরুর দিকের যাত্রা মোটেই সুবিধার ছিল না। প্রথম দিকের হাবল এর পাঠানো ছবিগুলো ছিল অনেকটা অস্পষ্ট।

Video Source:DCODE by Discovery

তাই এতো বড় কর্মযজ্ঞ এর এই রকম পরিণতির জন্য নাসা এর হাবল এর টীম লিডার চার্লি পেরেলিন কে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এই ভুলকে তৎকালীন সময়ে জাতীয় বিপর্যয় বলেও ঘোষণা করা হয়।

নাসা আপ্রাণ চেষ্টা করে আর হাবল এর হাই স্পিড ফটোমিটার গুলি ঠিক করার জন্য costar এর মতো সাহায্যকারী মিরর এর সাহায্য নেয়। হাবল টেলিস্কোপ যেহেতু স্পেস এ তখন ছিল তাই এটি সারাই এর কাজ ও বেশ কষ্টসাদ্ধ আর জটিল ছিল। costar এর ওজন ছিল প্রায় ৭০০ পাউন্ড এর মতো।

অবশেষে ১১ দিন পরে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সালে costar এর ইনস্টল এর পর যখন ছবি প্রথম হাবল পাঠালো তখন সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো। হাবল পাঠলো অসাধারণ সব ছবি। চার্লি পেরেলিন আবেগতাড়িত হয়ে ঘটনাটিকে চন্দ্রাভিযান এর পর সবচেয়ে বড় জ্যোতির্বিদ্যা এর সাফল্য বলে থাকেন।

অনেক সময় হাবল এর ফোকাস মহাকাশের এমন দিকে রাখা হয় মাসের পর মাস যেখানে আপাতদৃষ্টিতে কিছু নেই মনে হলেও সেখানেই পরে পাওয়া যায় লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি। এই হাবল টেলিস্কোপ এর সাহায্য তাই একদিকে যেমন নানা গ্যালাক্সি সম্পকে অধ্যয়ন সম্ভব হয় তেমনি সম্ভব হয় আমাদের গ্যালাক্সি এর জন্মলগ্ন থেকে তার ইতিহাস সম্পর্কেও জানা যায়।

হাবল টেলিস্কোপ অন্যান্য সাধারণ টেলিস্কোপ এর থেকে আলাদা কেন ?

হাবল টেলিস্কোপ পৃথিবী এর উপর থাকে অন্য টেলিস্কোপ থেকে অনেক আলাদা এর কারণ পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডল এর উপর থাকতে এর কার্যকারিতা আর ছবির ম্যান অনেক পরিষ্কার আর উচ্চমানের।

হাবল টেলিস্কোপ কি ভাবে কাজ করে ? হাবল টেলিস্কোপ কতটা শক্তিশালী ?

হাবল টেলিস্কোপ অনেক শক্তিশালী। হাবল টেলিস্কোপ এর মধ্যে আছে গাইডেন্স সেন্সর,পয়েন্ট কন্ট্রোলিং সিস্টেম যার সাহায্য এটি বহু কোটি মাইল দূরে থাকা গ্যালাক্সি এর ছবি তোলে নিপুন দক্ষতায়। এক মাইল দূরে কোনো বস্তুর ছবি তোলার জন্য এটি কোনো অপসারণের দরকার পরে না এটি এমন শক্তিশালী।

হাবল টেলিস্কোপ এর মধ্যে আছে দুটি মিরর। একটি প্রাইমারি আর একটি সেকেন্ডারি। প্রাইমারি মিরর ক্যামেরা টি মানব চক্ষুর থেকে প্রায় ৪০০০০ গুন্ বেশি আলোক সংঘৰ্ষ করে তার সেকেন্ডারি মিরর কে পাঠায় যা আবার পরে নানা ভাবে তার মধ্যে থাকা নানা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের বিশ্লেষণের জন্য পাঠানো হয়।

হাবল টেলিস্কোপ এর প্রধান ক্যামেরা হলো এর ‘The Wide Field Camera 3 ‘ যেটি দৃশ্যমান আলো ,প্রায় ultraviolet ,প্রায় ইনফ্রারেড আলোক দেখে তা বিশ্লেষণ করতে পারে যেখানে মানুষ শুধুমাত্র দৃশ্যমান আলোক দেখতে পায়। হাবল টেলিস্কোপ এর মধ্যে থাকা স্পেক্টোগ্রাফ ultraviolet রশ্মি বিশ্লেষণ করে গ্যালাক্সি এর জন্ম ,মৃত্যু, ঘোষ নক্ষত্র এর বিশ্লেষণ করতে পারে সহজেই।

হাবল টেলিস্কোপ এর Space Telescope Imaging Spectrograph মহাজাগতিক বস্তুর আণবিক গঠন, রাসায়নিক বিশ্লেষণ ,তাপমাত্রা ,ঘনত্ব,গতিবেগ বিশ্লেষণ করে। আমাদের প্রিয় পৃথিবীর দিকে কোনো গ্রহাণু ধেয়ে আসছে কিনা তার খবর আগাম জানিয়ে দিতে এর জুড়ি মেলা প্রায় অসম্ভব।

এছাড়া হাবল টেলিস্কোপ এর মধ্যে থাকা Multi-Object Spectromete ও আরো দূরের গ্যালাক্সি,গ্রহ নক্ষত্র এর কেমিকাল গঠন ,দূরত্ব বিশ্লেষণ করতে অনেক সাহায্য করে।

হাবল টেলিস্কোপ এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবদান

হাবল টেলিস্কোপ এর কিছূ গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় ‘Hubble Ultra Deep Field’ ছবির কথা যেটি আজ পর্যন্ত দেখতে পাওয়া সবথেকে দূরের গ্যালাক্সি।

এছাড়া হাবল টেলিস্কোপ এর নানা সময়ের ছবি থেকে আমাদের ইউনিভার্স এর আকার,তার বয়স সম্পর্কেও একটি আনুমানিক সময় জানা গেছে। আমাদের গ্যালাক্সি এর বয়স প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর।হাবল টেলিস্কোপ এর সবথেকে দূরের গ্যালাক্সি যেটি আজ পর্যন্ত দেখা গিয়েছে সেটি হলো GN-z11 যেটি আমাদের থেকে প্রায় ১৩.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে আছে।

এছাড়া মহাকাশে থাকা ডার্ক এনার্জি ,ব্ল্যাকহোল এর সম্পর্কেও নানা গবেষণা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

পৃথিবী ছাড়াও অন্যান্য গ্রহের আবহাওয়া সম্পর্কেও নানা গবেষণা মূলক তথ্য বেশ উল্লেখযোগ্য।

হাবল টেলিস্কোপ কত ডাটা পৃথিবীতে পাঠায় ?

হাবল টেলিস্কোপ রোজ প্রায় ১৪০ গিগাবাইট ডাটা পৃবীতে পাঠায়।প্রথমে এটি স্যাটেলাইট এ সব তথ্য পাঠায় পরে সেখান থেকে সব তথ্য প্রতিবীতে থাকা নাসা এর Goddard Space Flight Center এ সব তথ্য পাঠায় আর তারপর সেখান থেকে Space Telescope Science Institute এ. এখানে উল্লেখযোগ্য হাবল টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া ছবি গুলো অনেক সময় নানা রং যুক্ত করে পাঠনো হয় যাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বস্তু কে আরো ভালো ভাবে গবেষণা করা যায়।

হাবল টেলিস্কোপ এর ভবিষৎ কি ?


২০২০ সালে হাবল টেলিস্কোপ এর প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেলো। হাবল টেলিস্কোপ এমন ভাবেই তৈরী করা হয়েছিল যাতে এটি সহজেই পরবর্তীকালে সংস্কার বা আপগ্রেড করা যায়.এতো মধ্যে পাঁচবার এটি আপগ্রেড করা হয়েছে। শেষবার হয়েছিল ২০০৯ সালে।

তবে সর্বশেষ খবর হিসাবে এটি হাবল টেলিস্কোপ এর শেষ আপগ্রেড যার পরে এর আর কোনো আপগ্রেড করা যাবে না আর হিরে ধীরে এটি এর কার্যকারিতা হারাবে। তবে আসার কথা ৩০ বছর পরেও এটি আজ ঠিক ভাবে কাজ করছে।

নাসা এর খবর হিসাবে হাবল এর বিকল্প রূপে ইতিমধ্যে James Webb Space Telescope এর তৈরী আর তার ব্যাবহার সম্পকে কাজ শুরু হয়ে গেছে যেটি হাবল এর মতোই দারুন সব তথ্য দেবে।

তবে পৃথিবীকে প্রদিক্ষন করার বদলে এটি সূর্য কে প্রদিক্ষন করবে যার ফলে এটি আরো ভালো করে কাজ করতে পারবে।এটি একটু ইনফ্রারেড ক্যামেরা ভিত্তিক টেলিস্কোপ হবে যেটি হাবল এর থেকেও আকারে বড়ো হবে যার মফলে মহাবিশ্বের যতীন মেঘ,ধুলিকণা সরিয়ে আরো নতুন দিগন্তের সন্ধান দেবে বলেই নাসার দাবি।

শেষ কথা :আশা করি হাবল টেলিস্কোপ সম্পর্কে এই পোস্ট আপনাদের ভালো লাগলো। হাবল সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে নিচে কমেন্ট করে জানান। ধন্যবাদ।

সৌমিক ঘোষ

About সৌমিক ঘোষ

সৌমিক ঘোষ একজন ইন্টারনেট মার্কেটিং প্রফেশনাল, ব্লগার। তিনি ইন্টারনেট মার্কেটিং এ প্রায় ১২ বছর ধরে কাজ করছেন ।ব্লগিং ছাড়াও অবসর সময় এ গান শোনা তার একটি নেশা।

View all posts by সৌমিক ঘোষ →

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।